দাবার ইতিহাসই পাল্টে দিল ১২ বছর বয়সের ছেলেটি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ভারতীয় বংশোদ্ভূত অভিমন্যু মিশ্র এখন বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার। গতকাল হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে তৃতীয় নর্ম অর্জনের মধ্য দিয়ে সে সের্গেই কারাকিনের ১৯ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভাঙে।
কারাকিন, প্রথমে ইউক্রেন ও পরে রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করে ২০০২ সালে ১২ বছর ৭ মাস বয়েস সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার দাবাড়ুর খেতাব অর্জন করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে বসবাস করা অভিমন্যু ১২ বছর ৪ মাস ২৫ দিন বয়সে ভাঙলো কারাকিনের রেকর্ড। ২০১৬ সালে নরওয়ের দাবাড়ু ম্যাগনাস কার্লসেনকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যালেঞ্জ করে জিততে পারেননি কারাকিন।
অভিমন্যু ও তার বাবা গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জনের লক্ষ্যে গত এপ্রিল থেকে বুদাপেস্টে ছিলেন। গত দুই মাসে দুইটি নর্ম অর্জন করে অভিমন্যু। ভেজেরকেপজো জিএম মিক্সে ভারতের গ্র্যান্ডমাস্টার লিওন মেনদোনকাকে কালো ঘুঁটি নিয়ে হারিয়ে তৃতীয় নর্ম অর্জন করে এই বালক। সোচিতে ফিদে বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার আগে এটাই ছিল অভিমন্যুর শেষ টুর্নামেন্ট।
একজন দাবাড়ুকে গ্র্যান্ডমাস্টার হতে তিনটি জিএম নর্ম এবং ইএলও রেটিংয়ে ন্যূনতম ২৫০০ পয়েন্ট ছুঁতে হয়। এমন নর্ম অর্জন করা যায় সেসব টুর্নামেন্টে, যেখানে অন্তত ৫০ শতাংশ প্রতিদ্বন্দ্বী শিরোপাধারী এবং কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ গ্র্যান্ডমাস্টার।
দাবাড়ু অভিমন্যু দাবার অঙ্গনে নানা বিষয়ে সর্বকনিষ্ঠ হওয়াকে প্রায় অভ্যাসে পরিণত করেছে। সর্বকনিষ্ঠ আন্তর্জাতিক মাস্টারের রেকর্ডও তার দখলে। অনূর্ধ্ব-৯ বয়সসীমায় বিশ্বে সর্বোচ্চ রেটিংয়ের খেলোয়াড় হওয়ার পর ২০১৮ সালে তাকে তিন দিনের মূল্যায়ন প্রকল্পে ডেকেছিল কাসপারভ দাবা ফাউন্ডেশন। দাবায় উঠতি প্রতিভাদের সেই প্রকল্পে অভিমন্যু ছিল সর্বকনিষ্ঠ।
এর ফলে অভিমন্যু সামনে বছরে অন্তত দুই বার সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপরভের সঙ্গে দাবা নিয়ে যোগাযোগের পথ খুলে যায়। এর পাশাপাশি বিভিন্ন জিএম কোচদের সঙ্গে অনুশীলন সেশন তো ছিলই।
অভিমন্যুর বাবা হেমন্ত মিশ্র ইএসপিএনকে বলেন, ‘এই বয়সে গ্যারিকে পথপ্রদর্শক হিসেবে পাওয়া যেকোনো দাবাড়ুর জন্যই স্বপ্ন। বাবা-মায়েদের সাক্ষাৎকারের পর্বও ছিল সেখানে, এটি সম্ভবত আমার জীবনের সেরা দিন।’
কাসপরভ অভিমন্যুকে যখন দাবা নিয়ে নানা পরামর্শ দেন, তখন বিশেষ অনুমতি নিয়ে সেই কামরায় থাকেন বাবা হেমন্ত মিশ্র। কাসপারভের খুঁটিনাটি পরামর্শ লিপিবদ্ধ করেন তিনি। করোনা মহামারি শুরুর পর কাসপরভের সঙ্গে অভিমন্যুর সেশন চলছে অনলাইনে।
তার বাবা প্রায় আড়াই বছর বয়সে অভিমন্যুকে দাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ধীরে ধীরে দাবায় প্রতিভা উন্মেষের পর শারীরিক ধকল সইতে সমস্যা হতো অভিমন্যুর। সাড়ে পাঁচ বছর বয়সে একবার নিউ জার্সি ওপেনে খেলা মাঝরাত পেরিয়ে যাওয়ার পর জেগে থাকতে সমস্যা হচ্ছিল তার।
ওই ঘটনা নিয়ে অভিমন্যুর বাবার স্মৃতিচারণা, ‘তার প্রতিপক্ষ বুঝতে পেরেছিল, একটা শিশু কোনোভাবেই এতক্ষণ জেগে থাকতে পারবে না, তাই ঘণ্টাখানেক ধরে সে কোনো চাল দেয়নি। অভিমন্যু ড্রয়ের প্রস্তাব দিলেও সেই প্রতিপক্ষ রাজি হয়নি—“না, আমি জয়ের পথে আছি।”’ বাবার ভাষায়, সেই হার নাকি অভিমন্যুর ‘জীবন পাল্টে দিয়েছিল।’
তারপর থেকে বাবা-ছেলে জুটি বেঁধে দাবার অঙ্গনে মানিয়ে নেওয়ার লড়াই শুরু করে। খেলা চলাকালে রাউন্ডের মাঝে একটু ঘুমিয়ে নেওয়া থেকে গাড়ি কিংবা টুর্নামেন্ট কক্ষে ঘুমোনোর অভ্যাস করতে হয়েছে অভিমন্যুকে। সেই হারের পরের বছর ৩৫ বছর বয়সী দাবার কোচের সঙ্গে এক ম্যাচ রাত দুইটা পার হয়ে গিয়েছিল।
তখন অভিমন্যু ঠান্ডা পানিতে চোখমুখ ধুয়ে এসে আবার বসলেও জেগে থাকা কষ্টকর হয়ে উঠছিল। বয়স যে মাত্র সাড়ে ছয় বছর! ভাগ্য ভালো, দ্রুতই তার প্রতিদ্বন্দ্বী হেরে যায়। অভিমন্যুর বক্তব্য ছিল, ‘আমি তোমার চেয়ে ভালো খেলোয়াড় বলে জিতিনি, শেষ দিকের খেলায় তুমি পটু নও বলেই আমি জিতেছি।’
আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে বেশির ভাগ দাবাড়ু যেখানে অনুশীলনে কম্পিউটার ব্যবহার করে থাকেন, অভিমন্যু সেখানে খুব অল্প বয়স থেকেই দাবার বইয়ে ধ্যানস্থ হয়েছে। মাত্র ছয় বছর বয়সেই ‘সিলম্যানস কমপ্লিট ইন্ডগেম কোর্স’ আত্মস্থ করেছে সে। দুই বছর আগে আন্তর্জাতিক মাস্টার নর্মের পিছু ছোটার আগে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে রাত তিনটা পর্যন্ত জেগে প্রস্তুতি সেরেছে অভিমন্যু। এমনকি রাতে বাইরে হাঁটতেও বের হয়েছে।
তার বাবা হেমন্ত বলেন, ‘একবার জিএম (গ্র্যান্ডমাস্টার) হওয়ার পর সে নিজের জীবন নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সে টুর্নামেন্ট খেলবে, নাকি দাবায় থাকবে, সেটা তার সিদ্ধান্ত।’ তবে দাবার নেশা যার পেয়ে বসেছে, এই বয়সেই যে গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন করেছে, সে যদি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে না চায়, সেটাই হবে বিস্ময়কর।