ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে রেকর্ড সংখ্যক নরমাল ডেলিভারি।।
বর্তমান সরকার দেশের সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলো মায়েদের সিজারের পরিবর্তে নরমাল ডেলিভারিকে প্রধান্য দিচ্ছে। সারা দেশে নরমাল ডেলিভারিতে জোড় দেওয়ার কারনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেড়েছে গর্ভবতী নারীদের নরমাল ডেলিভারির সংখ্যা।
তেমনই গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া ২৫০শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল (সদর) হাসপাতালে রেকর্ড সংখ্যক নরমাল ডেলিভারি হয়েছে।
বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস সংকটময় সময়েও ব্রাহ্মণবাড়িয়া ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে এবার ব্যতিক্রম ঘটেছে। ২০২০ সালে জানুয়ারি মাস থেকে চলতি বছরের মার্চের ১৬ তারিখ পর্যন্ত এই হাসপাতালের গাইনি বিভাগে ৭৬৮টি শিশু নরমাল ডেলিভারিতে জন্মগ্রহণ করেছে। বিপরীতদিকে একই সময়ে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে শিশু জন্ম নিয়েছে প্রায় দুই শতাধিক। যা নরমাল ডেলিভারির তুলনায় প্রায় চার ভাগের একভাগ।
হাসপাতালের গাইনী বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী লক্ষ্য করা যায়, গত বছর ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ৮৫ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৮৭ জন, মার্চে ৬৩ জন, এপ্রিলে ২৫ জন, মে মাসে ৪১ জন, জুনে ১৯ জন, জুলাইয়ে ২০ জন, আগস্ট মাসে ৫২ জন, সেপ্টেম্বরে ৪৭ জন, অক্টোবরে ৫৭ জন, নভেম্বরে ৭৭ জন, ডিসেম্বরে ৫৫ জন, ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ৫৭ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৫৭ জন ও ১৬ মার্চ পর্যন্ত ২৬ জন শিশু নরমাল ডেলিভারিতে জন্মগ্রহণ করে। এদের মধ্যে ৮টি যমজ শিশু জন্ম হয়।
এছাড়াও গত ১৪ মাসে এই হাসপাতালে ১১৩টি শিশু মৃত ডেলিভারি হয়। যার মধ্যে ছেলের মৃত্যুর সংখ্যা মেয়ের মৃত্যুর সংখ্যা কম। তবে মৃত্যুর সংখ্যায় তিনটি ছিল যমজ শিশু।
গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে করোনাভাইরাসের মহামারিতে সরকার ঘোষিত লকডাউনের কারণে প্রায় তিন মাস হাসপাতালে প্রসূতি রোগী আসে তুলনামূলক অনেক কম। গত বছরের জুন ও জুলাই মাস প্রসূতি মা ও নবজাতক করোনা ভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ায় এ দুইমাস দুইবার লকডাউন করা হয়েছিল। এ লকডাউনের কারনে সেসময় নরমাল ডেলিভারি কমে যায়। করোনা ভাইরাস আতংক ছড়িয়ে যাওয়ায় নিরুপায় হয়ে বাড়িতে নরমাল ডেলিভারি করার চেষ্টা করতো ওই গর্ভবতীরা। যা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ।
গাইনী চিকিৎসকরা বলছেন, গর্ভবতীকালীন সময়ে গর্ভবতী মায়ের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, খিচুনি, ইউটিআই, শারিরীক দুর্বলতা ও রক্তসল্পতা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়। এছাড়া বাচ্চা আকারে বড় হয়ে গেলে, বাচ্চার হার্ট রেট বেড়ে গেলে বা কমে গেলে এবং যদি নরমাল ডেলিভারি মা ও শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায় তাহলে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকরাই সিজারিয়ান ডেলিভারি করে থাকেন।
আর নরমাল বা স্বাভাবিক প্রসব মা ও নবজাতক সন্তান উভয়ের জন্যই মঙ্গলময়। এখন সরকারি হাসপাতাল ও মা ও প্রসূতি সেবা কেন্দ্রে ব্যথামুক্ত স্বাভাবিক প্রসব করা হচ্ছে। একটি নরমাল ডেলিভারির ১২ ঘণ্টার মধ্যেই মায়েদের হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া সম্ভব। যেহেতু নরমাল ডেলিভারিতে ঝামেলা কম তাই মায়েরা খুব দ্রুত শিশুদেরকে বুকের দুধ পান করাতে পারেন এবং খুব শিগগিরই স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করতে পারেন। নরমাল ডেলিভারির পর কারো যদি কোনো ইনফেকশন হয় অথবা কেও যদি ভবিষ্যতে কনসিভ করতে চান তাহলে আর কোনো সমস্যা হয় না।
বেসরকারি বা সরকারি হাসপাতালে নরমাল ডেলিভারি করোনা হলে, বাচ্চা প্রসবের পর মায়ের পেটে কোনো অপারেটিভ স্কার বা দাগ থাকবে না। টাকা পয়সার বিষয়ে চিন্তা করতে হয় না, সেটাও লাগছে না। পরবর্তী সময়ে তার যদি আবার প্রসব হয়, সেসময়ও স্বাভাবিক হবে। হাসপাতালে থাকা কমে যাবে, সংক্রমণের আশঙ্কাও কমে যাবে। এমনকি যেই শিশুটা হয় তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকে, অসুস্থতার সম্ভাবনা কমে যায়, ওই শিশু বেশি সুস্থ থাকে।
প্রসূতি মা মিতালী শ্রী নন্দ বলেন, সরকারি হাসপাতালে না আসলে বুঝতাম না যে, নরমাল ডেলিভারি ও সিজারিয়ান করতে কোন টাকা লাগে না। নরমাল ডেলিভারিতে তার কোন ব্যাথা হয়নি। হাসপাতাল থেকে ওষুধ থেকে শুরু করে নার্সরা সময় সময়ে এসে খোঁজ নিচ্ছেন।
২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডা. ফৌজিয়া আক্তার বলেন, করোনার মহামারির সময়ে প্রসূতি মায়েদের অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। দেশে লকডাউনের কারণে প্রসবব্যথা ওঠার পর পরিবহন সমস্যায় অনেক রোগী বাড়িতেই সন্তান প্রসব করেছেন। তবে কিছু ক্ষেত্রে বাড়িতে নরমাল ডেলিভারি হওয়ায় জরায়ু ছিঁড়ে সমস্যা হয়েছে। অনেকে মারাও গেছেন।
তিনি আরও বলেন, করোনার সময়ে আমরা চিকিৎসা নিতে আসা প্রসূতিদের মোবাইল নম্বর রেখে দিতাম এবং হাসপাতালে প্রসূতি মায়েরা যেখানে চিকিৎসা নিতে আসতেন সেখানকার ফোন নম্বরও তাদের দিয়ে দিতাম। এতে অনেক প্রসূতি ব্যথা ওঠার পর সরকারি হাসপাতালে যোগাযোগ করে বাড়িতে নরমাল ডেলিভারি করিয়েছেন । করোনার মাঝেও আমরা সরকারি এই হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা প্রসূতিদের ডেলিভারি করেছি। নরমাল ডেলিভারির বিষয়ে আমরা করোনার আগে থেকেই রোগীদের কাউন্সেলিং করেছি। এইক্ষেত্রে আমরা সফলতা পেয়েছি।
এই বিষয়ে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. শওকত হোসেন বলেন, সরকার প্রসূতিদের চিকিৎসা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখছে। মা ও নবজাতক শিশুর মৃত্যুর হার কমানোর জন্য সরকার চিকিৎসক ও নার্সদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন। যার ফল ইতিমধ্যে আমরা পেয়েছি।
নরমাল ডেলিভারির জন্য রোগীদের কাউন্সেলিং করার বিষয়টি বেশি কাজ করেছে। হাসপাতালের বহিঃবিভাগের ১১৫ নম্বর কক্ষে প্রসূতিদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। ওই কক্ষের মোবাইল নম্বর রোগীদের দিয়ে রাখা আছে। তাছাড়া প্রসূতিদের নম্বরও রাখা হচ্ছে। তাদের সময়মতো ফোন করে নানা রকম সেবা ও হাসপাতালে আসার সময় পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে।