লিবিয়ায় ২০ হাজার বাংলাদেশী পাচারের জন্য অপেক্ষায়
লিবিয়ার ত্রিপোলির জাওয়ারা সাগরপাড় এলাকার আশপাশের ক্যাম্পগুলোতে আনুমানিক ১৫ থেকে ২০ হাজারেরও বেশী বাংলাদেশীকে জড়ো করা হয়েছে ইউরোপের দেশ ইতালিতে পাচারের জন্য। এসব বাংলাদেশীদেরকে দালালদের সাথে মোটা অঙ্কের টাকার চুক্তিতে ঢাকা থেকে দুবাই হয়ে সেখানে নেয়া হয়েছে।
লিবিয়ার সঠিক পরিস্থিতি ও সময় বুঝে তাদেরকে কাঠের নৌকায় তুলে দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো এসব পাচার হওয়া বাংলাদেশীর অধিকাংশই মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজৈর এলাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত এলাকার।
সম্প্রতি শতাধিক বাংলাদেশী স্বপ্নের দেশ ইতালির উদ্দেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে লিবিয়ার শেষ সীমান্ত জাওয়ারা সাগরপাড়ে কোস্টগার্ডের হাতে ধরা পড়েন। তাদেরকে আইওএম (IMO) এর সহায়তায় নেয়া হয় লিবিয়ার ত্রিপোলির ডিটেনশন ক্যাম্পে। আর সেখান থেকেই সাড়ে তিন লাখ টাকার চুক্তিতে মুক্তি মেলে মাদারীপুরের এক যুবকের।
মাদারীপুরের ওই যুবক গত বুধবার তার পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একটি পত্রিকাকে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় পাচার হওয়া এসব বাংলাদেশীর সর্বশেষ অবস্থানের কথা জানিয়ে লিবিয়া থেকে সমুদ্রপথে ইউরোপের ভয়ঙ্কর মানবপাচারের বেশ কিছু চিত্র তুলে ধরেন।
মাদারীপুরের যুবকটি অবশ্য না জেনেই ফাঁদে পড়ে এ পথে ইউরোপ যাওয়ার লক্ষ্যে যে ভুল করেছেন, সেই ভুল যেন আর কোনো বাংলাদেশী ভাই না করেন সে জন্যই বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কাছে তিনি দাবি জানিয়ে বলেন, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজৈর এলাকার চিহ্ন্তি দালালদের মাধ্যমে ইউরোপে মানবপাচারের ঘটনা বেশি ঘটছে।
অনেক বাংলাদেশী লিবিয়ায় আসার পর ধরা পড়ে বর্তমানে লিবিয়ায় দালালদের হাতে আটক হয়ে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। টাকা না দেয়ার কারণে অনেকের মুক্তি মিলছে না। দালালরা দফায় দফায় তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছে ফোন করে টাকা চাচ্ছে। আর টাকা দিতে না পারলে ভয়ংকর নির্যাতন করা হয় সেখানে, এমনকি মেরেও ফেলা হয়।
তিনি বলেন, এর জন্য দ্রুত তদন্ত করে প্রথমেই বাংলাদেশের দালালদের গ্রেফতার করা দরকার। কারণ বাংলাদেশী দালালরাই মূলত প্রধান অপরাধী, তারা টাকার জন্য অনেকের জীবন নষ্ট করে দিচ্ছে। তারা জেনেশুনেই পরিবার গুলোকে সারাজীবনের জন্য ধ্বংশ করে দিচ্ছে।
মাদারীপুরের ওই যুবক দাবি জানান যে, বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসও যেন আটকদের উদ্ধারের পাশাপাশি দালালের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। নতুবা এই মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যদের হাতে বাংলাদেশের আরো অনেক মানুষ নিঃশেষ হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে অনেকের পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ।
বাংলাদেশী দালালের মধ্যস্থতায় লিবিয়ার গুলসেল ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকায় মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশী যুবক জেলের বর্ণনা দিয়ে বলেন, আমি ২৩ দিন ছিলাম জেলে। এই সময়ে ক্যাম্পে সকালের নাশতা তারা ঠিকমতো দিত না। ২৪ ঘণ্টায় দুই বেলা খাবার দিত। তাও প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অল্প। খাবার পানি দিত না। টয়লেটের ট্যাব থেকে আমাদের পানি খেতে হতো। মোবাইল নিয়ে কারো ভেতরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমি কৌশল করে মোবাইল নিয়ে সেখান থেকে দু’টি ছবি তুলেছিলাম।
ভুক্তভোগী যুবকটি আরও বলেন, ক্যাম্পে এক রুমে যেখানে থাকার কথা ৫০ জনের সেখানে থাকতে দিচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০ জনকে। ইন্টারন্যাশনাল আইন অনুযায়ী এটি অন্যায়। আমি সাড়ে তিন লাখ টাকায় মুক্তি পেয়েছি। তবে দেখেছি ক্যাম্পে এমনও বাংলাদেশী আছেন, যারা এক বছরেও তাদের আত্মীয়-স্বজনের সাথে কথা বলতে পারেননি। আত্মীয়-স্বজন মনে করেছে, তার লোক মনে হয় মারা গেছে নতুবা সাগরে ভেসে গেছে।
আপনি কিভাবে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় মানবপাচারের শিকার হলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার সাথে মাদারীপুরের এক দালালের চুক্তি হয়েছে আট লাখ টাকায় সে আমাকে ইউরোপে ঢুকিয়ে দেবে। এর জন্য প্রথমে দালাল কোনো টাকা নেবে না। যাওয়ার পর আমার আত্মীয় টাকা পরিশোধ করবে এই শর্তে আমি রাজি হয়ে যাই।
রাজধানীর রামপুরা আবুল হোটেলের পাশের একটি অফিস থেকে শাহিন নামের এক ব্যক্তি আমার দুবাই পর্যন্ত যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট, টিকিট ভিসা ও বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট পার হওয়ার জন্য ৫০০ ডলার সাথে দিয়ে দেয়।
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কতিপয় লোকদের সাথে কন্ট্রাক্ট থাকায় তাকেসহ অন্যদের বেশি জেরা করা হয়নি জানিয়ে বলেন, দুবাই পৌঁছে তিন দিন থাকার পর বেনগাজির ফ্লাইটে তুলে দেয়া হয় আমাদের। এর আগে চুক্তি মোতাবেক পাঁচ লাখ টাকা আমার পরিবারের কাছ থেকে নেয়া হয়। আর ওই ফ্লাইটে সবাই ছিল বাংলাদেশী।
তিনি বলেন, বেনগাজি থেকে সড়কপথে কয়েক শ’ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় লিবিয়ার শেষ সীমানা জাওয়ারা সাগরপাড় সংলগ্ন সীমান্তের ক্যাম্পে। গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পর সাগরপাড়ের আশপাশে ক্যাম্প থেকে এরপর একদিন কাঠের নৌকায় তুলে দেয়া হয় আমাদের। নৌকায় উঠানোর আগেই চুক্তি অনুযায়ী আট লাখের বাকি তিন লাখ টাকা নিয়ে নেয় বাংলাদেশ থেকে।
আমাদের নৌকা ছাড়ার কিছুক্ষণ পরই লিবিয়ান কোস্টগার্ডের সদস্যরা এসে আমাদেরকে ধরে ফেলে। এরপর তুলে দেয়া হয় আইওএমের হাতে। আর এ সময় লিবিয়ান কোস্টগার্ড আমাদের সাথে থাকা মোবাইল, ডলার সবই ছিনিয়ে নেয়। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) খাবার দিয়েছে। সেটিও তারা রেখে দিয়েছে। এটা অমানবিক। সেখান থেকে আমাদের নেয়া হয় ক্যাম্পে। ক্যাম্পে ২৩ দিন থাকার পর সেখান থেকে আমি মুক্ত হই।
তিনি বলেন, আমি লিবিয়ার সাগরপাড়ের আশপাশের ক্যাম্পগুলোতে যে চিত্র দেখেছি সেই হিসাবে ২০ হাজারেরও বেশী বাংলাদেশীকে সেখানে জড়ো করা হয়েছে। এদের সাথে ঘানা, আফ্রিকা ও সুদানসহ অন্যান্য রাষ্ট্রেরও নাগরিক রয়েছে।
ক্যাম্প থেকে সাগরপাড় এর দূরত্ব কতটুকু হতে পারে জানতে চাইলে মাদারীপুরের যুবক বলেন, সেটি সর্বোচ্চ ১০-১৫ মিনিটের হাঁটার পথ হবে।
দালালদের লোকজন লিবিয়ায় সবসময় সশস্ত্র অবস্থায় থাকে। এটা দেখে মনে হয় লিবিয়ার সেখানকার প্রশাসনের সাথে তাদের একটা গোপন চুক্তি আছে। তা না হলে কিভাবে এত লোক সেখানে জড়ো করে তারা?
ভুক্তভোগী যুবকটি অপর এক প্রশ্নে বলেন, আমি যে ভুল করেছি এই ভয়ানক পথে পা বাড়িয়ে, সেই একই ভুল যেন আমাদের দেশের আর কেউ না করেন সে জন্য আমি এসব তথ্য প্রকাশ করেছি।
ভুক্তভোগী ওই লোকটি বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে যেসব কর্মকর্তা মাসে এক বা দুইবার ত্রিপোলির ক্যাম্পে ভিজিট করতে যান তারা সঠিকভাবে খোঁজ নিলে কিন্তু অনেকের কষ্ট কম হতো। অন্তত খাবারের যে কষ্ট তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। দূতাবাসের লোক চাইলেই তার সমাধান করতে পরেন।
মাদারীপুরের কয়েকজন দালালের নাম জানিয়ে তিনি বলেন, তাদেরকে এলাকার সবাই চেনে। তাদের মাধ্যমে লিবিয়ার ক্যাম্পে আটক থাকা বাংলাদেশীদের মুক্তির জন্য দেশ থেকে টাকা পাঠাচ্ছে অনেক আত্মীয়-স্বজন। ওরাই মূলত দালাল।
দালালদের মধ্যে মোয়াজ্জেম হোসেন ঢালী, মিজানুর রহমানসহ অনেক পরিচিত ও ভয়ংকর দালাল রয়েছে। তাদেরকে আগে গ্রেফতার করা হলে মানবপাচার চক্রের সিন্ডিকেটের অনেক তথ্যই বেরিয়ে আসবে বলে তিনি দাবি করেন। সূত্র : নয়া দিগন্ত।