আমাদের প্রিয় কবি আল মাহমুদ
পঞ্চাশের দশকে কুয়াশাচ্ছন্ন এক শীতের সকাল৷ ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশনে ট্রেন থেকে নামলেন সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ আঠারো বছরের এক যুবক৷ পরনে তাঁর খদ্দরের জামা ও পায়জামা, পায়ে রাবারের স্যান্ডেল আর বগলের নিচে ভাঙা টিনের একটা সুটকেস৷ যুবকটির দিকে এক ঝলক তাকালেই বুঝা যায় নিতান্তই মফস্বলের এক যুবক কোন এক দুর্বিপাকের তাড়া খেয়ে এখানে এসেছে৷ চোখেমুখে স্বপ্নভরা।
ঢাকায় আসা নিয়ে যুবক নিজেই বলেন, “পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে আমি একটা টিনের সুটকেস নিয়ে ফুলবাড়িয়া স্টেশনে এসে নামলাম। সম্ভবত সেটা ছিলো শীতকাল। সন্দেহ নেই আমি কবি হওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে এ প্রাচীন মোগলাই শহরে পা রেখেছিলাম। এসেছিলাম অবশ্যই কবি হতে। আজ অনেক বছর শহরে আছি।
আমার সুটকেসের ভেতর আমি নিয়ে এসেছিলাম বাংলাদেশের সবগুলো নদী, পাখি, পতঙ্গ, নৌকা, নর-নারীসহ বহমান আস্ত এক বাংলাদেশ। যেমন, জাদুকররা তাঁদের দ্রষ্টব্য দেখান। আমার ভাঙা সুটকেস থেকে জাতিকে দেখিয়েছি। আমার দ্রষ্টব্য দেখে বাংলার মানুষ কখনো কখনো হাততালি দিয়েছেন, আবার কখনো অশ্রুসিক্ত হয়েছেন।
আমি এখনো এই শহরেই আছি। আমি যখন এসেছিলাম তখন আমার বন্ধুদের বগলের নিচে থাকতো সিলেক্টেড পয়েমস জাতীয় ইউরোপের নানা ভাষার নানা কাব্যগ্রন্থ। আমি যেমন আমার ভাঙা সুটকেস থেকে আমার জিনিস বের করে দেখিয়েছি তারাও তাঁদের বগলের নিচের পুঁজি থেকে নানা ভেলকি দেখিয়েছেন।
এখনো আমি এই শহরেই আছি। আমার সেসব বন্ধুদের সৌভাগ্য হয়নি। এই মহানগরীতে তাঁদের নাম তরুণরা উচ্চারণ করেন না।” রাজনৈতিক সচেতনতা আর আর মাতৃভাষার প্রতি দায়ভার থেকে-ই যুবকটি কর্মতৎপরতা চালাতে থাকেন। ভাষা-আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির জন্য চাঁদা সংগ্রহ, রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন যুবকটি। ভাষা -আন্দোলন কমিটির লিফলেটে চার লাইনের একটি কবিতা ছাপা হলো,
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?
বরকতের রক্ত।
কবিতাটি ছাপা হলে পুলিশ মরিয়া হয়ে উঠে যুবকটিকে ধরতে, তার জন্য হানা দেয় যুবকের বাড়িতে। কারণ যুবকটির অপরাধ তিনি একজন কবি এবং শুধু কবি নন একজন সাহসী প্রতিবাদী সত্তা, যে নিজ মাতৃভাষার জন্য মরিয়া!
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেলেন, যুবকটির নাম কি? হ্যা, তিনি আমাদের প্রিয় কবি আল মাহমুদ। তিনি শুধু কবি নন ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক। সাহিত্যের সব জায়গায় রয়েছে তার বিচরণ।
১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই প্রবল বর্ষণের এক রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামের কাপড় ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আল মাহমুদ। আল মাহমুদ নামে পরিচিত হলেও পূর্ণাঙ্গ নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। পিতা আব্দুর রব মীর ও মা রৌশন আরা বেগম। কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার সাধনা হাই স্কুল এবং পরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাই স্কুলের পড়াশোনা করেন।
মূলত এই সময় থেকেই তাঁর লেখালেখিতে হাতেখড়ি। তবে শৈশবে শিক্ষক হিসেবে সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন কবির দাদিমা। দাদিমাকে নিয়ে কবি লিখেছেন, “আমার শৈশব তার উষ্ণ স্নেহের ক্রোড়ে অতিবাহিত হয়েছে। আমার অতি শৈশবের স্মৃতি বলে যদি কিছু থাকে তা হলো আমার দাদীর সেই পবিত্র মুখাবয়ব। পান খাওয়া লাল দুটি ঠোঁট ও তার মুখ নিঃসৃত অদ্ভুত সব রুপকথা। সিলেটে মুসলিম বীরদেহ আগমনকালের রোমাঞ্চকর কাহিনীর ভান্ডারও যেন তার কাছে গচ্ছিত ছিলো। পরতে পরতে তিনি মেলে দিতেন ধর্মীয় আত্নত্যাগের সেই ইতিহাস।”
পেশাগত জীবনের দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালে কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী ‘কাফেলা’ পত্রিকার চাকরি ছেড়ে দিলে তিনি সেখানে সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। এরমধ্যে ১৯৬৩ সালে তার কাব্যগ্রন্থ ‘লোক-লোকান্তর’ তারপর ‘কালের কলস’, ‘সোনালি কাবিন’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে উঠো’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থগুলোর জন্য তাঁর কবি খ্যাতি ছড়িয়ে পরে।
তখন সবার মুখে মুখে কবি আল মাহমুদ, কবি আল মাহমুদ হিসেবে গুনগুন শোনা যেত। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। এই সময়ে তিনি গল্প লেখার দিকে মনোযোগী হন। স্বাধীনতা পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে এক বছর তাঁকে জেলে কাটাতে হয়েছে।
পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু তাকে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক পদে নিয়োগ দেন এবং সেখান থেকে ১৯৯৩ সালে পরিচালনা পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
আল মাহমুদের অমর কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালী কাবিন’ সমকালীন বাংলা কবিতার একটি বাঁকের নাম। বলা হয়ে থাকে, তিনি যদি শুধু এই একটিমাত্র কাব্যগ্রন্থ রেখে যেতেন, তাতেও বাংলা কবিতার রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে থাকতেন। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, চেতনায় ও বাক্যভঙ্গিতে সমৃদ্ধ করেছেন।
একটি সাক্ষাৎকারে আল মাহমুদ বলেছিলেন, বাংলাদেশের বহু নদীর পানি স্বর্গীয় পীযূষজ্ঞানে আক্ষরিক অর্থেই হাতের আঁজলায় ভরে তিনি পান করেছেন। তাঁর এই মৃত্তিকাবর্তী মোহনীয় মানস তাঁর কবিতার মধ্যেও দেখা যায়। আধুনিক বাংলা কবিতার শহরমুখী প্রবণতার মধ্যেও তিনি ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং নর-নারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে কবিতায় অবলম্বন করেছেন।
আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যে স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ তাঁর অনন্য কীর্তি। তাঁর জাদু স্পর্শে সৃষ্টি হয়েছে অনন্য পঙ্ক্তিমালা। যে মৃত্যু তাঁকে নিয়ে গেল, সেই মৃত্যু নিয়ে ‘সোনালি কাবিন’ কবিতায় তিনি লিখে গেছেন,
‘প্রেম কবে নিয়েছিল ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ
মরণের পরে শুধু ফিরে আসে কবরের ঘাস
যতক্ষণ ধরো এই তাম্রবর্ণ অঙ্গের গড়ন
তারপর কিছু নেই, তারপর হাসে ইতিহাস।’
কথার জাদুতে মানুষকে সহজে সম্মোহিত করার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিলো আল মাহমুদের। তাঁর কথার জাদু নিয়ে এহসান হাবিব লিখেছিলেন, ১৯৯৫ সালের কথা, বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পে ছিলাম সেই সময়ে। একদিন প্রকল্প পরিচালক মুহম্মদ নুরুল হুদা বললেন, আল মাহমুদ আগামীকাল আসবেন। তখন ওখানে অনেকেই প্রতিবাদ করলো, বললো, আল মাহমুদকে আসতে দেওয়া হবে না। এদের সংখ্যা পঁচিশ-ত্রিশজন।
হুদা ভাই বললেন, “আশা করি তোমরা তাঁর সাথে লেখকসুলভ আচরণ করবে। তাঁর মতাদর্শ নিয়ে তাঁর সামনেই প্রশ্ন করবে। লেখকের মতোই তাঁর সঙ্গে তর্ক করবে। তোমরা কি রাজনৈতিক কর্মী? লেখকের মতো করে তাঁকে মোকাবেলা করো।” এরপর আসতে দেওয়া হবে, কিন্তু ঢুকতে দেওয়া হবে না, এরকম একটি অবস্থার মধ্যে আল মাহমুদ এলেন।
তিনি ঢুকলেনও। সবারই প্রস্তুতি ছিলো, তাঁকে বাক্যবাণে জর্জরিত করা হবে। কিন্তু তিনি আসার পর যখন বক্তৃতা শুরু করলেন, দশ মিনিটের মধ্যেই সবাই শান্ত হয়ে গেলো। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতে লাগলো। এমনকি বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর যারা তাঁকে আসতে দেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিল, তারাই তাঁর কাছে গিয়ে ফোন নম্বর, অটোগ্রাফ এবং বাসার ঠিকানা নিতে শুরু করলো।
কবিদের প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে আল মাহমুদ বলেছিলেন, “আমার কাছে প্রেম কবি জীবনের অপরিহার্য সম্পদ। আর একটা দেশের সঙ্গে, তাঁর প্রকৃতির সঙ্গে, মাটি ও নদীর সাথে একজন কবির রক্ত-মাংস জড়িত। দেশ যেমন থাকে, একজন কবিও তেমনি থাকেন। তার চোখে কোনো ভালো-মন্দ নেই। দেশবোধ তো থাকবেই। এটা আসলে মানুষের একটা আকাঙ্খা।
এ আকাঙ্খা থাকেই। এ আকাঙ্খা কখনো কাজে লাগানো যায়, কখনো যায় না। কিন্তু সৃজনবেদনা যেটাকে বলে- তৈরি করার জন্য, সৃষ্টি করার জন্য মানুষের মনে একটা অ্যাগনি, পেইন থাকে, যাকে সৃজনের বেদনা বলি। কবির মধ্যে তা থাকবে সবচেয়ে বেশি। সে বেদনাকে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে এর মধ্যে কী আছে।”
কবি আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে যে অবদান রেখে গেছেন, তার জন্য তাকে একটিমাত্র লেখায় বর্ণনা করা একেবারেই অসম্ভব। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের জাতীয় আত্মপরিচয় গড়ে তোলার একেবারে নেপথ্যে যারা ছিলেন তাঁদের মধ্যে আল মাহমুদ একজন। আর বায়ান্নর ভাষা শহীদদের স্মরণে তাঁর লেখা বিখ্যাত কবিতা মতো গভীর ডেফিনেশন কবিতা দ্বিতীয় কেউ লিখতে পারেনি এবং ভবিষ্যতে পারবে কিনা তা হয়ত ভবিষ্যত-ই বলে দিবে!
হুমায়ূন আহমেদ যদি আধুনিক বাংলা গদ্যসাহিত্যের রাজা বলা যায়, তাহলে আল মাহমুদ নিঃসন্দেহে কবিতার জগতে একচ্ছত্র সম্রাট। তবে বলতে হয় কবি যতটা সন্মানের প্রাপ্য তা আমরা তাঁকে দিতে পারিনি। বৃদ্ধ বয়সে তিনি অনেকটা অবহেলিত এবং উপেক্ষিত ছিলেন সমাজের ধারে! তার প্রাপ্য সম্মানটুকু যে তিনি পাননি; তা কবিরও ধারণা ছিলো একরকম।
তাঁর প্রবন্ধ সংকলন ‘সাহসের সমাচার’ গ্রন্থে তিনি এ কথাটি-ই বলেছেন এভাবে, “তোমরা আমাকে বোঝোনি। আমি বলি না বুঝবে না, বুঝবে। তবে তখন আমি আর থাকবো না। তবে এটা মনে রেখো, বাংলা সাহিত্যে যারা কিছু করতে চাও, আমাকে তোমার পাঠ করতেই হবে। এটা আমার আত্মবিশ্বাস।”
কষ্ট করে নিজেই নিজের জায়গা তৈরি করেছেন। তার জন্য নানা ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করতে হয়েছে। একবার এক সাক্ষাৎকারে কবি অভিমান সুরে বলেছিলেন, “আমার কাঁধে বিরাট সংসার। আমার রোজগার দিয়ে ছেলেমেয়েদের বড় করতে হয়েছে। ভালো কোনো চাকরি আমাকে কেউ দেয়নি। প্রচুর শ্রম দিতে হয়েছে। নানা ধরনের গদ্য লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু করতে পারলাম না। বন্ধুদের, কবিদের দেওয়া মানসিক চাপ উপেক্ষা করে সমাজে জায়গা করে নিতে হয়েছে আমাকে। কেউ কোনো স্পেস আমাকে দিতে চায়নি। অনেক ধাক্কা খেয়েছি, মুক্তিযুদ্ধ করেছি, জেলও খেটেছি। আমাকে বলো, একজন কবি আর কী কী করতে পারে? আমাকে স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়নি। এখন কোনো কিছুতেই আমার আর আফসোস নেই।”
শেষের সময়ে এসে তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে নানা জনের নানান মত ও বিতর্ক ছিলো। এসব বিতর্কের উর্ধ্বে আল মাহমুদের কবি সত্তা! কারণ- তাঁর বড়ো পরিচয় তাঁর কবিতা। রাজনৈতিক বিচারে তার মানদন্ড করা যায়। তিনি কবি এবং কবি। খোদার কাছে কবির পরম ইচ্ছে ছিলো, শুক্রবারে কোনো এক সময় যেন মৃত্যুর ডাক আসে! ‘স্মৃতির মেঘলাভোরে’ কবিতায় কবি বলেছিলেন, ‘কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রি শেষে শুভ শুক্রবারে মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।’
কোনো এক শুক্রবার যদি মৃত্যু এসে ‘যাওয়ার তাকিদ’ দেয় তাহলে সেই মৃত্যুকে তিনি ‘ঈদ’ হিসেবে সানন্দে গ্রহণ করবেন। তাইতো খোদা তার আরজি কবুল করেছেন, মৃত্যুর ফেরেশতা শুক্রবারের সকালেই কবুল করে নিয়েছেন। কাল কবির জন্মদিন ছিল, শুভ জন্মদিন আল মাহমুদ।
সৌজন্যে – রুবেল হোসেন
তথ্য সহায়ক:
১. যেভাবে বেড়ে উঠি – আল মাহমুদ
২. ইমরান মাহফুজের সাক্ষাৎকার, ডেইলি স্টার
৩. এহসান হাবিবের স্মৃতিচারণ, দৈনিক জনতা
৪. প্রথম আলো ও উইকিপিডিয়া