আলিশা মার্টের গ্রাহকরা টাকা-পণ্য কিছুই পাচ্ছেন না
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলিশা মার্ট অবিশ্বাস্য সব অফার দিয়ে দেশে আলোচনায় আসে। তাদের ফাঁদে পা দিয়ে আলিশা মার্টে গ্রাহকরা বিপুল পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু বর্তমানে গ্রহকরা তাদের কাছ থেকে বিনিয়োগের টাকা বা পণ্য পাচ্ছেন না।
গাহকদেরকে দেয়া চেকও ফেরত আসছে ব্যাংক থেকে। এরফলে আলিশা মার্ট অফিসে দিন দিন ভিড় বাড়ছে গ্রাহকদের। বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের দুশ্চিন্তা। গ্রাহকরা অফিসগুলোতে তাদের পণ্য ডেলিভারির জন্য বা জমা দেয়া অগ্রিম টাকা ফেরত নেয়ার জন্য ভিড় করছেন।
আলিশা মার্ট কর্তৃপক্ষ শুধুই তাদের আশ্বাসই দিচ্ছেন। গ্রাহকের ভিড়ের কারণে হিমশিম খাচ্ছে আলিশা মার্ট কর্তৃপক্ষ। কখনো কখনো ঘটছে উভয় পক্ষের মধ্যে বচসার ঘটনা। যেসব গ্রাহক মোটা অঙ্কের টাকা ওই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে লগ্নি করেছেন তারা অনেকেই সকালে অফিসে যাচ্ছেন আর বসে থাকছেন রাত পর্যন্ত। গ্রাহকের চাপের কারণে ভবন ও অফিসের নিরাপত্তারক্ষীরা অসহায় হয়ে পড়েছেন।
শুধু সাধারণ গ্রাহকই নয়, ওই অফিসে পণ্য ও টাকা উদ্ধারের জন্য অনেক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ওই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে ভিড় করছেন। কিন্তু, তারাও পণ্য ও টাকা ফেরত পাচ্ছেন না। অনেক গ্রাহক টাকা খোয়ানোর ভয়ে থানায় গিয়ে মামলা করতে চাচ্ছেন না। তারা মনে করছেন যে, থানায় মামলা করলে আলিশা মার্টের মালিক ও কর্মকর্তাদের ধরে নিয়ে যাবে পুলিশ। এতে তারা আর পণ্য পাবেন না।
সকল গ্রাহকদের দাবি, যারা আলিশা মার্টে বিনিয়োগ করেছেন তাদের পণ্য অথবা টাকা ফেরতের জন্য অবিলম্বে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে হস্তক্ষেপ করতে হবে। নইলে আলিশা মার্টের অফিসে যেকোনো সময় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। তাদের অভিযোগ হলো সরকার এখন থেকে সজাগ হলে অনেকের জীবন বাঁচবে। সব সময় দেখা যায় যে, সরকার প্রথম দিকে নিশ্চুপ থাকে, এতে তারা গ্রাহকদের টাকা অন্য জায়গায় সরিয়ে নেয়ার পর্যাপ্ত সময় পায়।সরজমিন অফিসে উপস্থিত গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
উল্লেখ্য যে, ২০২১ সালের ১লা জানুয়ারিতে অনলাইনে পণ্য বিক্রির কার্যক্রম শুরু করে আলিশা মার্ট। পণ্য দেয়ার নাম করে তারা সংগ্রহ করেছে গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা। কিন্তু, অনেক গ্রাহককে পণ্য বুঝিয়ে দেয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আলিশা মার্টে ক্যাশ অন ডেলিভারি (সিওডি) বা পণ্য হাতে পাওয়ার পর পেমেন্ট পদ্ধতি নেই। ফলে সেখানে পণ্য ক্রয় করতে হলে অবশ্যই আগে থেকে অনলাইনে পেমেন্ট দিতে হবে। পেমেন্ট দেয়ার কয়েক মাস পর পণ্য দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয় গ্রাহকদের।
আলিশা মার্টের লেনদেনে অস্বচ্ছতা থাকার কারণে গত ১৭ই জুলাই ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিকাশ কর্তৃপক্ষ লেনদেন বন্ধ করেছে। এ ছাড়াও গত ২২শে সেপ্টেম্বর বাণিজ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন যে, আলিশা মার্টের পণ্য লেনদেনের বিষয়টিতে স্বচ্ছতা রয়েছে কিনা তা খোঁজ নেয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও গত ৩১শে আগস্ট রাজধানীর বনানীতে আলিশা মার্টের বনানী অফিসে ৫২ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে ভ্যাট গোয়েন্দারা।
এ ভ্যাট ফাঁকি বিষয়ে সিআইডি’র অতিরিক্ত ডিআইজি খন্দকার রফিকুল ইসলাম জানান, ‘লেনদেনে অস্বচ্ছতার কারণে একাধিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যদি কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
বনানীর কামাল আতাতুর্ক সড়কের পোস্ট অফিসের পাশের তৃতীয় তলায় আলিশা মার্টের অফিসে গিয়ে দেখা যায়, তিন রুমের বিশাল আকারের ফ্লোরে গ্রাহকরা কেউ চেয়ারে কেউ সোফায় বসে আছেন। সবার মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।
কোনো কোনো গ্রাহকের চোখে পানি টলমল করছিল। সেখানে কয়েকজন পুলিশ সদস্যদের দেখা গেল। তারা জানালেন, চটকদার অফার পেয়ে তারাও আলিশা মার্টে বিনিয়োগ করেছেন। এখন পণ্যের জন্য ঘুরছেন। আলিশা মার্টের অফিসে বিনিয়োগ করার কারণে তারা অনেকেই লজ্জায় কাউকে কিছু বলতে পারছেন না। তারাও দিনের পর দিন পণ্যের জন্য ঘুরছেন।
আলিশা মার্ট ভবনের বাইরে পুলিশের একটি ভ্যান দাঁড়ানো। ভ্যানে থাকা পুলিশের এক কনস্টেবল জানালেন, তারা রোস্টার অনুযায়ী এই এলাকায় ডিউটি করে থাকেন। আলিশা মার্টে দিন দিন গ্রাহকদের ভিড় বাড়ছে। কখন কী ঘটনা ঘটে যায় তা বলা যায় না। তাই তারা মাঝে মাঝে ভ্যান নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে থাকেন। আর কর্তব্যরত এস আই আলিশা মার্টের অফিসে গিয়ে পরিস্থিতি দেখে আসেন।
সবুজ নামে আলিশা মার্টে পণ্যের জন্য আবেদনকারী এক গ্রাহক কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, আলিশা মার্টের অফার পেয়ে তিনি মোটরসাইকেল কেনার ১২ লাখ টাকা দেন। কিন্তু, গত ৪ মাস ধরে তার পণ্য ডেলিভারি দেয়া হয়নি। তিনি আরও জানান, তার এখন শঙ্কা যে, তিনি আর পণ্য পাবেন না। এই ভয়ে তিনি আলিশা মার্টে আবেদন করেছেন যে, তার অর্থ যাতে ফেরত দেয়া হয়। ওই টাকা ফেরত না পেলে তাকে পথে বসতে হবে বলে তিনি জানান।
আশরাফুল ইসলাম নামে আরেক গ্রাহক জানালেন, আলিশা মার্টে তিনি একটি ফ্রিজ কেনার জন্য ৬ মাস আগে আগাম টাকা দিয়েছেন। কিন্তু, তার ফ্রিজ এখনো দেয়া হয়নি। তিনি প্রত্যেকদিন একবার করে আলিশা মার্টের অফিসে আসেন তার টাকা ফেরত নেয়ার জন্য।
রফিক নামের এক গ্রাহক জানান, তার টাকা ফেরতের কথা বলে তাকে ২ টি চেক দেয়া হয়, কিন্তু তা ব্যাংকে দেয়ার পর ডিসঅনার হয়, পরে এ অভিযোগ নিয়ে আসলে তাকে আবার নতুন তারিখের চেক দেয়া হয়। জানিনা কপালে কি আছে। যদি টাকা না পায় তাহলে মরা ছাড়া আর কোন রাস্তা খোলা নাই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার একটি থানার এস আই জানান, তিনি একটি পণ্য কেনার জন্য ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়েছেন আলিশা মার্ট কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু ৩ মাস হলো তার পণ্য ডেলিভারি দেয়া হয়নি। শুধু তারা ঘোরাচ্ছে। এ বিষয়ে বনানীর অফিসে আলিশা মার্টের এক মার্কেটিং কর্মকর্তাকে গ্রাহকের পণ্য ডেলিভারির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করেন।
গত ১লা জানুয়ারি রাজধানীর একটি হোটেলে আলিশা মার্টের অনলাইন শপিংয়ের যাত্রা শুরু হয়। আলিশা মার্টের বর্তমানে ১৯টি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কম মূল্যের কারণে ওই প্রতিষ্ঠানে লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে।