বীর মুক্তিযোদ্ধাকে মন্ত্রণালয়ের ভুলে খেসারত দিতে হচ্ছে
সহিদুল হক ভূঁইয়া ছিলেন একজন সাহসী সেনাবাহিনীর সৈনিক, ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমানে বয়সের ভারে ন্যুব্জ ৭২ বছর বয়সী এই মুক্তিযুদ্ধা যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্র হাতে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। আবার ওয়্যারলেস অপারেটর হিসেবে যুদ্ধের তথ্য আদান-প্রদানেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
এখন আর শরীরে আগের মতো শক্তি নেই এবং তার আয়ও নেই। এরজন্য তার ১০ মাস বাড়ি ভাড়া বাকি। এরইমধ্যে তিনবার বাড়িওয়ালা ডেকে নিয়ে তাগাদা দিয়েছেন। বলেছেন ভাড়া দিতে না পারলে যাতে বাড়ি ছেড়ে দেন।
এসব নিয়ে দারুণ টেনশনে তিনি। গত কয়েক মাস ঠিকমতো ওষুধও খেতে পারেননি। কারণ তিনবেলা খাবার জোগাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। সবমিলিয়ে যুদ্ধের ময়দান কাঁপানো ওই সৈনিক এখন প্রহর গুনছেন মুত্যৃর। মৃত্যুতেই শান্তি বলে জানালেন তিনি।
সহিদুল হক ভূঁইয়া স্বীকৃত মুক্তিযোদ্ধা হলেও আজ পর্যন্ত ভাতা পাননি। গত দুই বছর ভাতা পেতে দৌড়ঝাঁপ করেছেন সহিদুল হক ভূঁইয়া। শেষ জীবনে ভাতা দিয়ে চলতে ঘুরেছেন সরকারি কর্মকর্তাদের টেবিল থেকে টেবিলে। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের কক্ষের নাম্বারগুলো তার মুখস্থ। ওইসব কক্ষে এতবার যেতে হয়েছে যে, রীতিমতো মুখস্থ হয়ে গেছে।
সবচেয়ে ভয়ানক বিষয় হলো একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মুক্তিযুদ্ধা হিসেবে ভাতা পেতে ঘুষও দিয়েছেন তিনি। গত আড়াই বছরে দেড় লাখের বেশি টাকা ঘুষ হিসেবে খরচ হয়েছে তার। আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধার নিয়ে ঘুষের টাকা সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজ হয়নি। নামের ভুল থাকায় ভাতাও পাননি।
“বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। দেশ স্বাধীন করেছি। যার জন্য যুদ্ধে গেলাম শুনলাম তাকেই মেরে ফেলা হয়েছে। তাই রাগে, ক্ষোভে ও দুঃখে আর সেনাবাহিনীতে যোগ দেইনি। তিনি বলেন, যুদ্ধ করেছি কিন্তু কখনও সার্টিফিকেটের পেছনে দৌঁড়াইনি”
তিনি বর্তমানে ওই ভাতা পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। নিজের জীবনের বাকিটা সময় সঁপে দিয়েছেন ভাগ্যের ওপর। জাতীয় পত্রিকা মানবজমিন-এর কাছে সহিদুল হক ভূঁইয়া জানান তার জীবনে ঘটে যাওয়া বিড়ম্বনার কথা। বলেন, সেনাবাহিনীর সৈনিক হিসেবে যুদ্ধ করেছেন নাইন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। তখন কমান্ডিং অফিসার ছিলেন ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন।
ভারতে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তিনি। যুদ্ধের শেষদিকে রেজিমেন্টে ওয়্যারলেস অপারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সময়ের হিসাবে ওই দায়িত্ব ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধ শেষ যোগ দেন যশোর ক্যান্টনমেন্টে। সেখান থেকে আসেন ছুটিতে। এরইমধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনা শোনার পর আর সেনাবাহিনীতে যোগ দেননি সহিদুল হক ভূঁইয়া।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। দেশ স্বাধীন করেছি। যার জন্য যুদ্ধে গেলাম শুনলাম তাকেই মেরে ফেলা হয়েছে। তাই রাগে, ক্ষোভে ও দুঃখে আর সেনাবাহিনীতে যোগ দেইনি। তিনি বলেন, যুদ্ধ করেছি কিন্তু কখনও সার্টিফিকেটের পেছনে দৌঁড়াইনি।
২০১৯ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে আল আমিন নামের এক সিপাহী বাড়িতে এসে সেনাবাহিনী গেজেটে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার নামের তালিকা দিয়ে যায়। পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের চাপে ওই তালিকা নিয়ে যাই মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে। ভাতার আশায় দৌড়ঝাঁপ শুরু করি। বিপত্তি বাধে নাম ও এলাকার ভুল নাম নিয়ে।
সেনাবাহিনীর গেজেটে আমার পিতার নাম, এলাকার নাম ও ঠিকানা ঠিক দেয়া হলেও ভুল করা হয় আমার নামে। সহিদুল হক ভূঁইয়ার পরিবর্তে লেখা হয় সিদ্দিকুর হক ভুইয়া। একই সঙ্গে গ্রামের নাম সুহাতার পরিবর্তে লেখা হয় সুহাটা। অথচ সুহাটা নামে আশেপাশেও কোনো গ্রাম নেই। এ নিয়ে চেয়ারম্যানের একটি চিঠিও জমা দিয়েছি। এটা গেল এক বিপত্তি।
এরপরে কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্যবলীতে (১৩০৫) নামসহ অন্যান্য তথ্য সঠিকভাবে দেয়া হলেও গ্রামের নাম ভুল করে লেখা হয় গুহাটা। মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে জানানো হয়, যাচাই-বাছাই করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনাকে সঠিক বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে আপনি নামের সংশোধনীর আবেদন করেন। এটা ঠিক হলেই আপনাকে ভাতার আওতায় আনা হবে।
সেনা বীর মুক্তিযোদ্ধা সহিদুল হক ভুঁইয়া জানান, মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে ২০২০ সালের ১লা মার্চ সংশোধনী দিয়ে আবেদন করা হয়। ওই আবেদন নিয়ে মন্ত্রণালয়ের ৬০৮, ৬১২, ৯৯৭ সহ অনেকগুলো রুমে ঘুরেছি। সবাই কেবল আশ্বাস দিয়ে গেছে। কেউ ব্যবস্থা নেয়নি। চাহিদামতো ঘুষ দিয়েও ভাতা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি। কষ্ট লাগে এটা ভাবতে যে একজন মুক্তিযুদ্ধাকেও ঘুষ দিতে হয়। অথচ আমরা মুখে সততার বাণী প্রচার করি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে বর্তমানে নিজের দুরবস্থার কথা বর্ণনা করে সহিদুল হক ভুঁইয়া বলেন, তিন ছেলে ও তিন মেয়েকে নিয়ে দারুণ অর্থকষ্টে দিন কাটছে। তিনবেলা ঠিকমতো খাবারও পান না। এক ছেলে মিরপুরে ইন্টারনেটে কাজ করে মাসে ১০ হাজার টাকা পায়। আরেক মেয়ে শিশুবান্ধব এনজিওতে চাকরি করে মাসে ৩ হাজার টাকা পায়। পুরো পরিবারে আয় বলতে এই।
সহিদুল হক ভুঁইয়া বলেন, নামে ভুল করেছে মন্ত্রণালয়। আর খেসারত দিতে হচ্ছে আমাকে। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেলে হয়তো শেষ জীবনে একটু সুখ নিয়ে বেঁচে থাকতে পারতাম। জানি না ওই সুখটুকুও কখনও পাবো কিনা।