পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের গুদামে ফের আগুন, নিহত ৪
পুরান ঢাকার আরমানিটোলার ‘হাজী মুসা ম্যানশনে’ অগ্নিকা-ে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ভোর ৩টা ১৮ মিনিটে আবাসিক ভবনটির নিচতলার রাসায়নিকের গুদামে এই অগ্নিকা- ঘটে।
আগুনে মৃত তিনজন পুরুষ এবং একজন নারী। ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধমান গতকাল শুক্রবার সকালে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
দেবাশীষ বর্ধমান জানান, গতকাল ভোরে ঘটনাস্থল থেকে নিরাপত্তা কর্মী রাসেল মিয়ার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলুফার নামে ইডেন কলেজের এক শিক্ষার্থীকে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ছাড়া সকাল ১০টার পর ভবনের পাঁচতলা থেকে আরো দুজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তারা হলেন ওজিউল্লাহ ও নিরাপত্তাকর্মী শহীদুল ইসলাম।
দেবাশীষ বর্ধন আরো বলেন, এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাসহ অনেকেই আহত হয়েছেন। তারা মিটফোর্ড এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছেন।
অগ্নিকা-ে আহতরা হলেনÑ আশিকুজ্জামান (৩৩), তার স্ত্রী ইসরাত জাহান মুনা (৩০), শ্বশুর ইব্রাহিম সরকার (৬০), শাশুড়ি সুফিয়া বেগম (৫০), শ্যালক জুনায়েদ (২০), মোস্তফা (৪০), ইউনুস মোল্লা (৬০), সাকিব হোসেন (৩০), সাখাওয়াত হোসেন (২৭), সাফায়েত হোসেন (৩৫), চাষমেরা বেগম (৩৩), দেলোয়ার হোসেন (৫৮), আয়সাপা (২), খোরশেদ আলম (৫০), লায়লা বেগম (৫৫), মোহাম্মদ ফারুক (৫৫), মেহেরুন্নেসা (৫০), মিলি (২২), পাবিহা (২৬), আকাশ (২২) ও আসমা সিদ্দিকা (৪৫)। তাদের মধ্যে চারজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় আইসিইউতে রয়েছেন। বাকি ১৬ জন বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন।
এ ছাড়া মোস্তফা নামে একজন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। বৃহস্পতিবার রাত ৩টা ১৮ মিনিটের দিকে পুরান ঢাকার আরমানিটোলা ‘হাজী মুসা ম্যানশনে’ কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন লাগে।
ভবনের নিচতলায় আগুন লাগলে তার ধোঁয়ায় ভবনের দোতলা থেকে ছয়তলার বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বারান্দার গ্রিল কেটে সব ফ্লোরের লোকজনকে উদ্ধার করে নিচে নামিয়ে আনেন। শুক্রবার সকাল ৯টার পর আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে।
.ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি দল প্রায় ছয় ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নেভাতে সক্ষম হয়। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, ‘এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস তার আইন অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা নেবে।’
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, ‘এটি অপরিকল্পিত রাসায়নিক গুদাম। এই ভবনে আমরা কোনো ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা দেখতে পাইনি। ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি ১০-১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে।’
বংশাল থানার ওসি শাহীন ফকির বলেন, নিহত সুমাইয়া ওই ভবনের চতুর্থতলার একটি ফ্ল্যাটে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। তিনি ইডেন কলেজের ইংরেজি বিভাগে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। অগ্নিকা-ের পর পাশের এটি নির্মাণাধীন ভবন থেকে মই দিয়ে তার পরিবারের অন্য সদস্যদের বের করে আনা হয়। তবে সুমাইয়া অচেতন হয়ে মেঝেতে পড়ে যায়। তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
নিহত নিরাপত্তাকর্মী রাসেলের (৩০) মৃতদেহ দগ্ধ অবস্থায় দোতলা থেকে উদ্ধার করা হয় বলে শাহীন জানান। আহতদের মধ্যে চারজন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে ভর্তি রয়েছেন।
চিকিৎসকের বরাত দিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তাদের সবার অবস্থা আশঙ্কাজনক। বাকি ১৬ জন ওয়ার্ড ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরের উপপরিচালক (উন্নয়ন) নূর হাসানকে সভাপতি করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য তিন সদস্য হলেন ফায়ার সার্ভিসের জোন-১-এর উপসহকারী পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট ওয়্যারহাউসের দুজন পরিদর্শক।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ অগ্নিকা- ঘটে। সেখানে রাসায়নিকের গুদামে থাকায় আগুন বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এ অগ্নিকা-ে ৭৮ জন নিহত হন, আহত হন অনেকেই।
এর আগে ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ১২৪ জনের প্রাণহানি হয়। ওই ঘটনার পর থেকে পুরান ঢাকার রাসায়নিক ব্যবসায়ীদের ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন এবং নতুন লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রেখেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।
এর পরও তারা সেখানে অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনা অব্যাহত রেখেছেন। ওইসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও তারা নতুন করে সংযোগ নিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ঠিকানা পরিবর্তন কবা হয়েছে।
আর ভবন মালিকরাও বেশি টাকা ভাড়া পাওয়ায় চুপ থাকছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাসায়নিক গুদাম, কারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এখন পুরান ঢাকার ইসলামবাগ, চুড়িহাট্টা, চকবাজার, লালবাগ এলাকায় বেশিসংখ্যক রাসায়নিক কারখানা রয়েছে।